Social Icons

Share |

Thursday 23 October 2014

কালীপূজার উদ্ভব ও বিকাশ

তারাপদ আচার্য্য
বাংলায় 'পূজার' ধারণাটি সুপ্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন বাংলায় 'পূজার' প্রাথমিক ধারণার উন্মেষ বলে মনে করা হয়। কেননা, 'পূজা' শব্দটি বৈদিক আর্যদের সংস্কৃত ভাষার শব্দ নয়; 'পূজা' শব্দটি অস্ট্রিক ভাষার একটি শব্দ। সুপ্রাচীন বাংলার মানুষ কথা বলত ওই অস্ট্রিক ভাষায়।
'কালী' শব্দটি 'কাল' শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ 'কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ'। মহাভারত অনুসারে, এটি দুর্গার একটি রূপ। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী একটি দানবীর নাম। 'কাল', যার অর্থ 'নির্ধারিত সময়', তা প্রসঙ্গক্রমে 'মৃত্যু' অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এর সমোচ্চারিত শব্দ 'কালো'র সঙ্গে এর কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু লৌকিক ব্যুৎপত্তির দৌলতে এরা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে গেছে। মহাভারতে এক দেবীর উল্লেখ আছে যিনি হত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেন। তার নাম কালরাত্রি বা কালী। সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, এ শব্দটি নাম হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে আবার 'কৃষ্ণবর্ণা' বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
চামু-াচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বহির্বঙ্গে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত প-িত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন দীপান্বিতা অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের 'শ্যামাসপর্যা বিধি' গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ড. শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, 'কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যেভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলে মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।' তবে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। তার আগে কালী উপাসকরা তাম্রপটে ইষ্টদেবীর যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পূজা করতেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন_ "কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাঙ্গালার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে 'আগমবাগিশী' কা- বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।" অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এ সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বর্তমানে কালীপূজা বাংলায় দুর্গাপূজার মতোই সনাতনধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব।
কালী বা কালিকা হলেন সনাতনধর্মাবলম্বীদের উপাস্য শক্তির দেবী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে, তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্রমতে পূজিত প্রধান দশজন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী।
শাক্তরা কালীকে বিশ্বব্রহ্মা- সৃষ্টির আদিকারণ মনে করে। পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থে কালীর বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে সাধারণভাবে তাঁর মূর্তিতে চারটি হাতে খড়গ, অসুরের ছিন্নমু-, বর ও অভয়মুদ্রা; গলায় মানুষের মু- দিয়ে গাঁথা মালা; বিরাট জিভ, কালো গায়ের রং, এলোকেশ দেখা যায় এবং তাঁকে তাঁর স্বামী শিবের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
তন্ত্র ও পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের কথা পাওয়া যায়। তোড়লতন্ত্র মতে কালী অষ্টধা বা অষ্টবিধ। যেমন_ দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুন্ডা ইত্যাদি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আবার কালী নববিধা। এ তালিকা থেকেই পাওয়া যায় কালকালী, কামকলাকালী, ধনদাকালী ও চ-িকাকালীর নাম। আবার বিভিন্ন মন্দিরে 'ব্রহ্মময়ী', 'ভবতারিণী', 'আনন্দময়ী', 'করুণাময়ী' ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা প্রতিষ্ঠা ও পূজা করা হয়। দুর্গাপূজার পরের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমকসহকারে পালিত হয়। এ ছাড়া মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গল ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে।
সনাতনধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে_ দেবতা আর অসুরদের যুদ্ধে শুম্ভ নিশুম্ভ নামের দুই দানবের সঙ্গে যুদ্ধে দেবতারা পরাজিত হন। স্বর্গরাজ্য ফিরে পেতে দেবতারা আদ্যাশক্তি ভগবতীর স্তব করতে থাকেন। তখন দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী আবির্ভূত হন। সেই দেবী কৌষিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত। দেবী কৌষিকী শরীর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলে ভগবতী দেবী কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেন। সেই থেকে দেবী কালী নামে পরিচিত। পরে দেবী আবার মনোহর রূপ ধারণ করেন।
মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তকসহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়। গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়। দেবীর পূজায় ছাগ বা মহিষ বলির প্রথা রয়েছে। সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপূজা হতো। কোনো কোনো ম-পে কালী ও শিবের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার দুই বিখ্যাত কালীসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বামাখ্যাপার মূর্তিও পূজিত হয়। কোথাও কোথাও কালীর সঙ্গে সঙ্গে দশমহাবিদ্যাও পূজিত হন। দর্শনার্থীরা সারা রাত মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে কালীপ্রতিমা দর্শন করেন।
কালী দেবীর উপাসকরা সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ। কালীকে বিষয়বস্তু করে রচিত 'শ্যামাসঙ্গীত' বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।
রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কালী সাধক এবং কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ বিশিষ্ট কবি অনেক শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। 'মৃত্যুরূপা কালী' হলো দেবী কালীকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা একটি বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতা। ভগিনী নিবেদিতা 'মাতৃরূপা কালী' নামে একটি কালীবিষয়ক বইও রচনা করেছিলেন।
কালীপূজা সনাতনধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি। কালীপূজা মানে শক্তির আরাধনা করা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের শক্তি সঞ্চয় করতে মাকে উপাসনা করা। আর কালীপূজায় দীপাবলি হলো আলোর উৎসব। অশুভ শক্তিকে পরাজিত করে শুভশক্তির বিজয়ের প্রতীক শুভ দেওয়ালি বা দীপাবলি। অন্ধকারকে দূর করে শুভ ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠায় দীপাবলি উৎসব উদযাপন করা হয়।

তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

0 comments:

Post a Comment

 

Sample text

Sample Text

Sample Text